অস্থির হয়ে উঠছে বিশ্ব পণ্যবাজার

করোনা-পরবর্তী বিশ্ব-অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে থাকা দেশগুলো যখন মূল্যস্ফীতির চাপে খাবি খাচ্ছে, তখন সেই আগুনে ঘি ঢেলে দিচ্ছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ উত্তেজনা। বেসামাল হয়ে উঠছে জ্বালানি তেল ও সার্বিক পণ্যবাজার। গতকাল এক দিনেই জ্বালানি তেলের দাম সাড়ে ৩ শতাংশ বেড়ে ১০০ ডলারের কাছাকাছি পৌঁছেছে। সরবরাহ উদ্বেগে অত্যাবশ্যকীয় নিত্যপণ্য গম, ভুট্টা, ভোজ্য তেল, সোনা, রুপা ও শিল্পের প্রয়োজনীয় খনিজ ধাতুর দামই ঊর্ধ্বমুখী।

অস্থিরতা দেখা গেছে বৈশ্বিক শেয়ারবাজারেও। গতকাল সকালের বাণিজ্যে ইউরোপের বড় বাজারগুলোতে দরপতন ঘটে, তবে রাশিয়ার পক্ষ থেকে ইউক্রেনের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কের পথ খোলা আছে জানানো হলে বাজার ফের ইতিবাচক ধারায় ফেরে। তবে এশিয়ার শেয়ারবাজারগুলোতে দরপতন ঘটেছে। হংকংয়ের হ্যাংগ সেংগ সূচক ২.৭ শতাংশ পড়েছে। রাশিয়ার শেয়ারবাজারে সর্বোচ্চ দরপতন হয় ৮ শতাংশের বেশি।

গতকাল মঙ্গলবার সকালের বাণিজ্যে লন্ডনের অপরিশোধিত ব্রেন্ট তেলের দাম ৩.৪৮ ডলার বা ৩.৭ শতাংশ বেড়ে প্রতি ব্যারেল হয় ৯৮.৮৭ ডলার। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের অপরিশোধিত ডাব্লিউটিআই তেলের দাম ৪.৪১ ডলার বা ৪.৮ শতাংশ বেড়ে প্রতি ব্যারেল হয় ৯৫.৪৮ ডলার। যদিও দিন শেষে ব্রেন্ট তেল ৯৮ ডলারে নেমে আসে। তবে তা আগের দিনের চেয়ে ২.৫ শতাংশ বেশি।

ইন্টার-অ্যাক্টিভ ইনভেস্টরের বিনিয়োগবিষয়ক প্রধান ভিক্টোরিয়া স্কলার বলেন, ‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ উত্তেজনায় তেলের সরবরাহ বিঘ্ন হতে পারে—এমন উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া রাশিয়ার ওপর পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞায় তেল ও গ্যাস উভয় বাজারেই প্রভাব পড়বে। কারণ রাশিয়া বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ তেল রপ্তানিকারক এবং বিশ্বের শীর্ষ প্রাকৃতিক গ্যাস রপ্তানিকারক দেশ। ’ গতকাল যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রাকৃতিক গ্যাসের দামও ৪ শতাংশ বেড়ে প্রতি মিলিয়ন ব্রিটিশ থারমাল ইউনিট (এমএমবিটিইউ) হয় ৪.৬০ ডলার। একইভাবে ব্রিটেন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারেও এক দিনে প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম বাড়ে ৭ শতাংশ। ইউরোপ প্রায় ৩৫ শতাংশ প্রাকৃতিক গ্যাসের জন্য রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল।

বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ আর্থিক প্রতিষ্ঠান জেপি মরগান তাদের এক বিবৃতিতে জানায়, এ যুদ্ধ উত্তেজনায় তেলের দাম এ বছর প্রতি ব্যারেল ১২৫ ডলার এবং আগামী বছর ১৫০ ডলারে উঠে যেতে পারে। এতে বছরের প্রথম ভাগে বৈশ্বিক জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমবে ০.৯ শতাংশ এবং মূল্যস্ফীতি বেড়ে হবে ৭.২ শতাংশ।

পণ্যবাজারসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং ইকোনমিকসের হিসাব অনুযায়ী, রাশিয়া-ইউক্রেন উত্তেজনায় মূল্যবান ধাতু ও খাদ্যপণ্যের দামও বাড়ছে। গত এক সপ্তাহে সোনার দামে বেড়েছে ২.১৯ শতাংশ, রুপা ২.৮৯ শতাংশ, স্টিল ১.৫৪ শতাংশ, প্লাটিনাম ৫.৩৮ শতাংশ, সয়াবিন ৩.৯৮ শতাংশ, গম ৪.১৭ শতাংশ, ভুট্টা ৩.৮০ শতাংশ, পাম তেল ৩.২০ শতাংশ এবং চিনির দাম বেড়েছে ১.৬০ শতাংশ।

বৈশ্বিক ঝুঁকি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ভেরিস্ক ম্যাপলক্রপটের বিশ্লেষক ওফেলিয়া কাউটস বলেন, ‘ইউক্রেন হচ্ছে গম ও ভুট্টার অন্যতম বড় রপ্তানিকারক দেশ। যদি দেশটির রপ্তানি কোনো কারণে ব্যাহত হয়, তবে বিশ্বে এসব পণ্যের দাম ব্যাপকভাবে বেড়ে যাবে। ’

বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক বিশ্লেষণে বলা হয়, ইউক্রেনে হামলা হলে বাধার মুখে পড়তে পারে কৃষ্ণ সাগর দিয়ে বাণিজ্যিক জাহাজের চলাচল। এর প্রভাব হবে মারাত্মক। এতে এ পথ দিয়ে আমদানি-রপ্তানি করা সব খাদ্যশস্যের দাম বেড়ে যেতে পারে। খাদ্যশস্যের অন্যতম চার রপ্তানিকারক দেশ ইউক্রেন, রাশিয়া, কাজাখস্তান ও রোমানিয়া। এই দেশগুলোর পণ্য রপ্তানি হয় কৃষ্ণ সাগরের বিভিন্ন বন্দর দিয়ে।

ইউক্রেনে হামলা হলে এর প্রভাব পড়বে আর্থিক খাতেও। বেশি সমস্যায় পড়তে পারে ইউরোপের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। জেপি মরগানের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, অস্ট্রিয়ার রাইফেইসেন ব্যাংক ইন্টারন্যাশনাল, হাঙ্গেরির ওটিপি ও ইউনিক্রেডিট ব্যাংক, ফ্রান্সের সোসায়েটে জেনারেল ব্যাংক, নেদারল্যান্ডসের আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইএনজির ব্যবসা রয়েছে রাশিয়ায়। এসব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মুনাফার একটি অংশ আসে রাশিয়া থেকে। সংকটে পড়তে পারে পশ্চিমা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো। কারণ রাশিয়ার সঙ্গে নানাভাবে জড়িয়ে রয়েছে তারা। দেশটির সবচেয়ে বড় জ্বালানি তেল উত্তোলনকারী প্রতিষ্ঠান রসনেফটে ১৯.৭৫ শতাংশ মালিকানা রয়েছে যুক্তরাজ্যের বহুজাতিক জ্বালানি প্রতিষ্ঠান বিপির।

বিশ্বে প্রাকৃতিক ধাতুর অন্যতম উৎপাদক ও রপ্তানিকারক দেশ রাশিয়া। ফলে বাড়বে মূল্যবান ধাতুর দাম। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার শঙ্কার মুখে এর মধ্যেই নিকেল ও অ্যালুমিনিয়ামের দাম কয়েক বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। রাশিয়ার প্রধান প্রধান রপ্তানি পণ্যের মধ্যে রয়েছে সোনা, অ্যালুমিনিয়াম, কোবাল্ট, তামা, নিকেল, প্যালাডিয়াম ইত্যাদি।